বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বান্দরবান – পার্বত্য চট্টগ্রামের এক অনন্য জেলা, যেখানে প্রকৃতি তার অনন্ত সৌন্দর্য নিয়ে বিরাজ করে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং রহস্যময় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘দেবতাখুম’ – একটি নাম যা শুনলেই মনে ছবি ফুটে ওঠে পবিত্রতা আর দিব্য সৌন্দর্যের। রোয়াংছড়ি উপজেলার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা এই প্রাকৃতিক জলাধার শুধু একটি দর্শনীয় স্থান নয়, বরং বাংলাদেশের অন্যতম অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ।
দেবতাখুম আসলে একটি গভীর জলপ্রপাত যা পাহাড়ি এলাকার মধ্যে অবস্থিত, গভীর সবুজ জঙ্গল এবং উঁচু পাহাড়ের মাঝে যেন লুকিয়ে থাকা এক স্বর্গীয় স্থান। স্থানীয় মারমা ভাষায় ‘দেবতাখুম’ শব্দের অর্থ ‘দেবতাদের জলাশয়’ – একটি নাম যা এর অলৌকিক সৌন্দর্যকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এই অঞ্চল একটি অনাবিষ্কৃত স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত, এবং দেবতাখুমের আকর্ষণ প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
এই নিবন্ধে আমরা দেবতাখুমের ইতিহাস, ভূগোল, পর্যটন গুরুত্ব, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং এই অঞ্চল ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। চলুন, দেবতাখুমের রহস্যময় সৌন্দর্যের গভীরে যাত্রা করি।
দেবতাখুমের ঐতিহাসিক পটভূমি
উৎপত্তি ও নামকরণের ইতিহাস
দেবতাখুমের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। স্থানীয় মারমা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস অনুসারে, এই জলাশয়টি দেবতাদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল এবং পুরাকালে দেবতারা এখানে স্নান করতেন। মারমা ভাষায় ‘দেবতা’ শব্দটি ‘দেবতা’ বা ‘ঈশ্বর’ এবং ‘খুম’ শব্দটি ‘জলাশয়’ বা ‘পুকুর’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এভাবেই এই স্থানটি ‘দেবতাখুম’ বা ‘দেবতাদের জলাশয়’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
ঐতিহাসিক গবেষণা অনুসারে, এই অঞ্চলটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী, বিশেষ করে মারমা, ত্রিপুরা এবং চাকমা সম্প্রদায়ের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসের সাথে দেবতাখুমের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
প্রাচীন গ্রন্থে দেবতাখুমের উল্লেখ
পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহে দেবতাখুমের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থগুলিতে বর্ণিত আছে যে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু এই স্থানে ধ্যান ও সাধনা করতেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ১,০০০ বছর আগে থেকেই এই অঞ্চল পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
১৮৫৭ সালে রাখাইন রাজ্যের একজন ঐতিহাসিক ‘দেবতাখুম’ সম্পর্কে লিখেছিলেন, যেখানে তিনি এই স্থানকে “পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মল ও পবিত্র জলাশয়” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তার লেখা অনুসারে, এই জলাশয়ের জল অনেক রোগের নিরাময়ে সাহায্য করে এবং স্থানীয় আদিবাসীরা এই জলকে ঔষধি হিসেবে ব্যবহার করতেন।
আধুনিক যুগে আবিষ্কার
দেবতাখুম সাধারণ পর্যটকদের কাছে আবিষ্কৃত হয় অপেক্ষাকৃত সম্প্রতি। ১৯৮০-এর দশকে একদল পর্যটক এই অঞ্চল ভ্রমণকালে দেবতাখুম আবিষ্কার করেন এবং এর অসাধারণ সৌন্দর্য সম্পর্কে তথ্য প্রচার করতে শুরু করেন। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই অঞ্চলকে সংরক্ষিত প্রাকৃতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে, যা এর সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল।
২০০৫ সালে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (বাপক) দেবতাখুমকে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে প্রচার শুরু করে, এবং ২০১০ সালের পর থেকে এই স্থানটি ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। বর্তমানে, দেবতাখুম বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত।
ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য
অবস্থান ও অভিগম্যতা
দেবতাখুম অবস্থিত বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৪০ কিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে এটি ২১°৫৮’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°২৭’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।
দেবতাখুমে পৌঁছানোর জন্য প্রথমে বান্দরবান শহরে আসতে হবে। ঢাকা থেকে বান্দরবান পর্যন্ত বাস সার্ভিস উপলব্ধ, যা প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা সময় নেয়। বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ি উপজেলা সদর পর্যন্ত লোকাল জিপ বা চাঁদের গাড়ি পাওয়া যায়, যা প্রায় ২ ঘণ্টার যাত্রা। রোয়াংছড়ি থেকে দেবতাখুম পর্যন্ত একটি ট্রেকিং রুট রয়েছে, যা পায়ে হেঁটে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা সময় নেয়।
জলবায়ু ও আবহাওয়া
দেবতাখুম অঞ্চলের জলবায়ু মূলত উপ-শীতোষ্ণ মৌসুমি। এই অঞ্চলে বছরে গড়ে প্রায় ৩,০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়, যার বেশিরভাগই জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে হয়। উচ্চতার কারণে, এখানে তাপমাত্রা সমতলভূমির তুলনায় কিছুটা কম থাকে।
তাপমাত্রার পরিসর:
- গ্রীষ্মকাল (মার্চ – মে): ২৫°C – ৩২°C
- বর্ষাকাল (জুন – সেপ্টেম্বর): ২০°C – ২৭°C
- শীতকাল (নভেম্বর – ফেব্রুয়ারি): ১০°C – ২২°C
ভ্রমণের সেরা সময় হল অক্টোবর থেকে মার্চ মাস, যখন আবহাওয়া শুষ্ক থাকে এবং দেবতাখুমের জল স্বচ্ছ ও নীল রঙের হয়।
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য
দেবতাখুম একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত ও জলাশয় সিস্টেম, যা পাহাড়ি ঝর্ণা দ্বারা পুষ্ট হয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার স্ফটিক স্বচ্ছ নীল-সবুজ জল, যা ঝর্ণার মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে একটি প্রাকৃতিক জলাধারে জমা হয়। জলাশয়টির গভীরতা স্থান ভেদে ভিন্ন, সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ৪৫ ফুট।
জলাশয়ের চারপাশে ঘন সবুজ জঙ্গল রয়েছে, যেখানে অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বাস করে। পাহাড়ি ঢাল, বৃক্ষাচ্ছাদিত পর্বতমালা এবং ফার্ন ও অর্কিড সমৃদ্ধ বনভূমি দেবতাখুমকে একটি অভ্রান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঠিকানা করে তুলেছে।
সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের সময় দেবতাখুম দেখার অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয়। সূর্যের আলো যখন জলের উপর পড়ে, তখন জল নানা রঙে রঞ্জিত হয়ে ওঠে, যা একটি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য সৃষ্টি করে।
জৈববৈচিত্র্য
দেবতাখুম অঞ্চল বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল। এখানে পাওয়া যায় এমন কিছু উল্লেখযোগ্য প্রজাতি:
উদ্ভিদ:
- বাঁশ (বাংলাদেশের ১২টি প্রজাতির মধ্যে ৮টি এখানে পাওয়া যায়)
- অর্কিড (৩০+ প্রজাতি)
- ফার্ন (১৫+ প্রজাতি)
- চন্দন গাছ
- গরান গাছ
- সুন্দরী গাছ
- মেহগনি
প্রাণী:
- বনমোরগ
- বানর
- হনুমান
- বন্য শূকর
- হরিণ
- গিরগিটি
- সাপ (বিষাক্ত ও অবিষাক্ত উভয়)
- বিভিন্ন প্রজাতির পাখি (১০০+ প্রজাতি)
বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় জানা যায়, দেবতাখুম অঞ্চলে মোট ২২৭ প্রজাতির উদ্ভিদ ও ১৮৯ প্রজাতির প্রাণী বাস করে, যার মধ্যে ১৩টি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি অন্তর্ভুক্ত।
পর্যটন গুরুত্ব ও আকর্ষণ
দেবতাখুমের বিশেষ আকর্ষণ
দেবতাখুম কেবল একটি প্রাকৃতিক জলাশয় নয়, এটি অনেকগুলি অনন্য বৈশিষ্ট্যের সংযোগে গঠিত একটি সম্পূর্ণ পর্যটন গন্তব্য। এর প্রধান আকর্ষণগুলি নিম্নরূপ:
- স্বচ্ছ নীল জল: দেবতাখুমের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল এর অত্যন্ত স্বচ্ছ নীল-সবুজ জল, যা দূর থেকে দেখলে স্ফটিকের মতো ঝকঝকে মনে হয়। জলের এই রঙ তৈরি হয় জলে অবস্থিত খনিজ পদার্থের কারণে।
- সুইমিং স্পট: দেবতাখুমের কিছু অংশ সাঁতার কাটার জন্য আদর্শ। পর্যটকরা জলাশয়ের নির্দিষ্ট অংশে সাঁতার কেটে প্রকৃতির সাথে একাত্মতা অনুভব করতে পারেন।
- ট্রেকিং রুট: দেবতাখুমে পৌঁছাতে হলে একটি সুন্দর ট্রেকিং পথ অতিক্রম করতে হয়, যা পর্যটকদের জন্য স্বতন্ত্র আকর্ষণ হিসেবে কাজ করে। পথে ঘন বনভূমি, পাহাড়ি ঝরনা এবং বিভিন্ন ধরনের পাখি ও বন্যপ্রাণী দেখা যায়।
- জলপ্রপাত: দেবতাখুমের উত্তর দিকে একটি ছোট জলপ্রপাত রয়েছে, যা পর্যটকদের জন্য অতিরিক্ত আকর্ষণ। বর্ষা মৌসুমে এই জলপ্রপাত আরও সমৃদ্ধ এবং প্রবাহমান হয়ে ওঠে।
- পাহাড়ি সূর্যাস্ত দৃশ্য: দেবতাখুম থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অবর্ণনীয়। পাহাড়ি অঞ্চলে সূর্য যখন অস্ত যায়, তখন আকাশ নানা রঙে রঞ্জিত হয়ে ওঠে, যা ফটোগ্রাফারদের জন্য স্বর্গীয় সুযোগ।
পর্যটন পরিসংখ্যান
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেবতাখুমে পর্যটকদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের তথ্য অনুসারে:
বছর | পর্যটকের সংখ্যা | বৃদ্ধির হার (%) |
---|---|---|
2015 | 5,200 | – |
2016 | 7,500 | 44.2% |
2017 | 10,800 | 44.0% |
2018 | 15,500 | 43.5% |
2019 | 22,300 | 43.9% |
2020 | 8,100 | -63.7% |
2021 | 11,200 | 38.3% |
2022 | 18,500 | 65.2% |
2023 | 26,200 | 41.6% |
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পর্যটকের সংখ্যা হ্রাস পেলেও, ২০২১ সাল থেকে আবার বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালে দেবতাখুমে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটক আসেন, যা এই স্থানের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা নির্দেশ করে।
পর্যটন অবকাঠামো
দেবতাখুমে পর্যটন অবকাঠামো সম্প্রতি উন্নতি লাভ করেছে, তবে এখনও অনেক উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে:
আবাসন সুবিধা:
- রেস্ট হাউস: দেবতাখুমের কাছে বন বিভাগের কয়েকটি রেস্ট হাউস রয়েছে যেখানে পর্যটকরা থাকতে পারেন। এগুলি আগে থেকে বুকিং করতে হয়।
- ইকো কটেজ: স্থানীয় উদ্যোক্তারা দেবতাখুমের কাছে কয়েকটি ইকো কটেজ নির্মাণ করেছেন, যা পরিবেশবান্ধব এবং স্থানীয় স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত।
- টেন্ট ক্যাম্পিং: অনেক সাহসী পর্যটক দেবতাখুমের কাছে টেন্ট স্থাপন করে রাত কাটাতে পছন্দ করেন, যা একটি অভিনব অভিজ্ঞতা প্রদান করে।
খাবার ও পানীয়:
- দেবতাখুমে কোন রেস্টুরেন্ট নেই, তাই পর্যটকদের নিজেদের খাবার নিয়ে যেতে হয় বা স্থানীয় গাইডের মাধ্যমে খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়।
- স্থানীয় আদিবাসী গ্রামগুলিতে কিছু ছোট খাবারের দোকান রয়েছে যেখানে সীমিত খাবার পাওয়া যায়।
অন্যান্য সুবিধা:
- গাইড সার্ভিস: স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত গাইডরা পর্যটকদের দেবতাখুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপলব্ধ।
- পার্কিং: রোয়াংছড়ি থেকে দেবতাখুমের ট্রেকিং শুরুর স্থানে একটি পার্কিং এরিয়া রয়েছে।
- তথ্য কেন্দ্র: রোয়াংছড়িতে একটি পর্যটন তথ্য কেন্দ্র রয়েছে যেখানে পর্যটকরা দেবতাখুম সম্পর্কে তথ্য পেতে পারেন।
দেবতাখুমের আদিবাসী সম্প্রদায় ও সংস্কৃতি
স্থানীয় জনগোষ্ঠী
দেবতাখুম অঞ্চলে বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস, যাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। এই অঞ্চলে বসবাসকারী প্রধান আদিবাসী গোষ্ঠীগুলি হল:
- মারমা সম্প্রদায়: এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী, যারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের নিজস্ব ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে।
- ত্রিপুরা সম্প্রদায়: দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী, যারা মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তারা তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বজায় রেখেছে।
- চাকমা সম্প্রদায়: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এই সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব লিপি ও সাহিত্য সংস্কৃতি সংরক্ষণ করে চলেছে।
- মুরং সম্প্রদায়: একটি ছোট আদিবাসী গোষ্ঠী, যারা প্রধানত কৃষিজীবী এবং তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে।
জনশুমারি ২০১২ অনুসারে, রোয়াংছড়ি উপজেলায় মোট জনসংখ্যার ৬৮% আদিবাসী, যার মধ্যে মারমা ৪১%, ত্রিপুরা ১৮%, চাকমা ৬%, এবং অন্যান্য আদিবাসী ৩%।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
দেবতাখুম অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে চলেছে:
উৎসব:
- সাংগ্রাই উৎসব: মারমা সম্প্রদায়ের নববর্ষ উদযাপন, এপ্রিল মাসে পালিত হয়।
- বৈসাবি: ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব, যা প্রতি বছর এপ্রিল মাসে পালিত হয়।
- বিজু: চাকমা সম্প্রদায়ের নববর্ষ উদযাপন।
পোশাক-পরিচ্ছদ:
- মারমা নারীরা রঙিন থামি (লুঙ্গি) ও ইংগি (ব্লাউজ) পরেন।
- ত্রিপুরা নারীরা রিগনাই (শাড়ির অনুরূপ পোশাক) পরেন।
- চাকমা নারীরা পিনন (শাড়ির অনুরূপ) ও খাদি ব্লাউজ পরেন।
খাদ্যাভ্যাস:
- নাপি (মাছের ফার্মেন্টেড সস)
- বাসক (বাঁশের কুড়ি দিয়ে তৈরি খাবার)
- সিদল (শাকের প্রকারভেদ)
- চিংরি মাছের ভর্তা
- বনের ফল-মূল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার
হস্তশিল্প:
- বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্য
- হাতে বোনা কাপড়
- কাঠের মূর্তি
- প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে তৈরি শিল্পকর্ম
দেবতাখুমের সাথে সম্পর্কিত লোককাহিনী
স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে দেবতাখুম সম্পর্কে অনেক লোককাহিনী প্রচলিত আছে:
- দেবতাদের স্নানের স্থান: সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, পূর্ণিমার রাতে দেবতারা এই জলাশয়ে স্নান করতে আসেন। তাই স্থানীয়রা পূর্ণিমার রাতে দেবতাখুম এড়িয়ে চলেন।
- রোগ নিরাময়ের জল: স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে, দেবতাখুমের জলে ঔষধি গুণ রয়েছে। অনেকে ত্বকের রোগ ও শারীরিক ব্যথা নিরাময়ের জন্য এই জলে স্নান করেন।
- অভিশপ্ত রাজকন্যা: একটি লোককাহিনী অনুসারে, একসময় এখানে একটি রাজ্য ছিল যার রাজকন্যা অভিশপ্ত হয়ে জলের দেবীতে পরিণত হন এবং এখনও এই জলাশয়ে বাস করেন।
- পবিত্র ছড়ি: মারমা লোককাহিনী অনুসারে, একবার বৌদ্ধ ভিক্ষু পুন্নাগা তার পবিত্র ছড়ি দিয়ে পাহাড়ে আঘাত করলে এই জলাশয়ের সৃষ্টি হয়।
এই লোককাহিনীগুলি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রচারিত হয়ে আসছে এবং দেবতাখুমের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ও রহস্যময়তা বৃদ্ধি করেছে।
ভ্রমণ গাইড ও টিপস
ভ্রমণের সেরা সময়
দেবতাখুম ভ্রমণের আদর্শ সময় হল শীত ও শরৎকাল, অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মার্চ মাস। এই সময়গুলিতে আবহাওয়া অনুকূল থাকে এবং ট্রেকিং পথ শুষ্ক ও সহজ থাকে। বর্ষা মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) দেবতাখুমের জল স্বচ্ছতা হারায় এবং ট্রেকিং পথ পিচ্ছিল ও বিপদজনক হয়ে ওঠে।
মাস অনুযায়ী ভ্রমণ উপযোগিতা:
- উত্তম: নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি
- ভাল: অক্টোবর, ফেব্রুয়ারি, মার্চ
- মোটামুটি: এপ্রিল, মে
- এড়িয়ে চলুন: জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর
প্রয়োজনীয় অনুমতি ও নিরাপত্তা
দেবতাখুম ভ্রমণের জন্য কিছু অনুমতি ও নিরাপত্তাজনিত বিষয় জানা অপরিহার্য:
- পার্বত্য জেলা ভ্রমণ অনুমতি: বাংলাদেশের সকল পর্যটকের জন্য বান্দরবান ভ্রমণের জন্য বান্দরবান জেলা প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
- জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি
- পাসপোর্ট সাইজ ছবি (২ কপি)
- ভ্রমণের সময়সূচি
- নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স: সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স নেওয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকদের জন্য।
- লোকাল গাইড: দেবতাখুম ভ্রমণের সময় স্থানীয় গাইড নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এলাকাটি দুর্গম এবং পথ জটিল।
- ট্রেকিং পারমিট: দেবতাখুমে যাওয়ার জন্য রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদ থেকে ট্রেকিং পারমিট নিতে হয়।
যাত্রা পরিকল্পনা
দেবতাখুম ভ্রমণের জন্য একটি সাধারণ যাত্রা পরিকল্পনা:
দিন ১:
- ঢাকা থেকে বান্দরবান যাত্রা (সকাল ৮টায় যাত্রা করলে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব)
- বান্দরবানে রাত্রিযাপন
দিন ২:
- সকালে (৮টায়) বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ি যাত্রা
- রোয়াংছড়িতে ট্রেকিং পারমিট সংগ্রহ
- স্থানীয় গাইড নিয়োগ
- দুপুরে খাবারের পর দেবতাখুমের উদ্দেশ্যে ট্রেকিং শুরু
- দেবতাখুমে পৌঁছে স্থানীয় রেস্ট হাউস বা টেন্টে রাত্রিযাপন
দিন ৩:
- সকালে দেবতাখুম উপভোগ, সাঁতার কাটা, ফটোগ্রাফি
- দুপুরের পর রোয়াংছড়ি ফেরত
- রোয়াংছড়িতে রাত্রিযাপন
দিন ৪:
- রোয়াংছড়ি থেকে বান্দরবান ফেরত
- বান্দরবান থেকে ঢাকা ফেরত
আবশ্যক সামগ্রী তালিকা
দেবতাখুম ভ্রমণের সময় নিম্নলিখিত সামগ্রীগুলি সাথে রাখা উচিত:
- জরুরি সামগ্রী:
- পরিচয়পত্র ও অনুমতিপত্র
- পর্যাপ্ত নগদ টাকা (এখানে ATM সুবিধা নেই)
- ফার্স্ট এইড কিট
- পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট
- জরুরি ঔষধ
- মশা নিরোধক সামগ্রী
- পোশাক:
- আরামদায়ক ট্রেকিং জুতা
- হালকা ও দ্রুত শুকানোর কাপড়
- সুইমসুট
- টুপি/ক্যাপ
- সানগ্লাস
- রেইন কোট (মৌসুম অনুযায়ী)
- ইলেকট্রনিক সামগ্রী:
- মোবাইল চার্জার/পাওয়ার ব্যাংক
- ক্যামেরা
- টর্চ লাইট
- অতিরিক্ত ব্যাটারি
- খাদ্য ও পানীয়:
- পর্যাপ্ত পানি
- ড্রাই ফুড/স্ন্যাকস
- ইনস্ট্যান্ট নুডলস/স্যুপ
- ফল
- অন্যান্য:
- ট্রেকিং ব্যাকপ্যাক
- স্লিপিং ব্যাগ
- টয়লেট পেপার
- টাওয়েল
- সানস্ক্রিন লোশন
- ওয়েট টিস্যু
সংরক্ষণ ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ
পরিবেশগত সমস্যা
ক্রমবর্ধমান পর্যটন দেবতাখুমের পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। প্রধান পরিবেশগত সমস্যাগুলি হল:
- জলদূষণ: অদায়িত্বশীল পর্যটকদের দ্বারা প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে, যা জলের গুণমান হ্রাস করছে।
- বনউজাড়: পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য স্থানীয় বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে, যা জৈববৈচিত্র্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
- বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল হারানো: ক্রমবর্ধমান মানব উপস্থিতি স্থানীয় বন্যপ্রাণীদের তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।
- ভূমিক্ষয়: অনিয়ন্ত্রিত ট্রেকিং ও পথ নির্মাণের কারণে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিক্ষয় বাড়ছে।
- শব্দদূষণ: অসংযত পর্যটকদের কারণে শব্দদূষণ বাড়ছে, যা স্থানীয় প্রাণীদের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ১০ বছরে দেবতাখুম অঞ্চলে বনাঞ্চল ৪.৮% হ্রাস পেয়েছে এবং জলের গুণমান ১৭% খারাপ হয়েছে।
সংরক্ষণ প্রচেষ্টা
দেবতাখুম সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে:
- সরকারি উদ্যোগ:
- ২০১২ সালে দেবতাখুম অঞ্চল “সংরক্ষিত প্রাকৃতিক এলাকা” হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
- বন বিভাগ নিয়মিত পরিবেশগত মনিটরিং করছে।
- পর্যটকদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দৈনিক পর্যটক কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।
- প্লাস্টিক ব্যাগ ও বোতল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
- বেসরকারি উদ্যোগ:
- “দেবতাখুম বাঁচাও” নামে একটি বেসরকারি সংস্থা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
- নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
- স্থানীয় সম্প্রদায়কে সংরক্ষণ কাজে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।
- পরিবেশবান্ধব পর্যটন (ইকো-টুরিজম) প্রচার করা হচ্ছে।
টেকসই পর্যটন
দেবতাখুমে টেকসই পর্যটন বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গুরুত্বপূর্ণ:
- পরিমিত পর্যটন: দৈনিক পর্যটকের সংখ্যা সীমিত রাখা।
- সম্প্রদায়-ভিত্তিক পর্যটন: স্থানীয় সম্প্রদায়কে পর্যটন ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করা, যাতে তারা আর্থিকভাবে উপকৃত হয়।
- পরিবেশ শিক্ষা: পর্যটকদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানো।
- শূন্য-বর্জ্য নীতি: সমস্ত পর্যটককে তাদের বর্জ্য ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা।
- পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো: স্থানীয় উপকরণ দিয়ে নির্মিত এবং ন্যূনতম পরিবেশগত প্রভাব সৃষ্টিকারী পর্যটন অবকাঠামো তৈরি করা।
দেবতাখুম ও স্থানীয় অর্থনীতি
স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাব
দেবতাখুম পর্যটন স্থানীয় অর্থনীতির উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে:
- কর্মসংস্থান সৃষ্টি: প্রায় ২৫০ স্থানীয় বাসিন্দা সরাসরি পর্যটন খাতে কর্মরত, যেমন গাইড, কুক, ড্রাইভার ইত্যাদি হিসেবে। আরও প্রায় ৫০০ ব্যক্তি পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছেন।
- ক্ষুদ্র ব্যবসা বৃদ্ধি: স্থানীয় খাদ্য বিক্রেতা, হস্তশিল্প বিক্রেতা, ট্রান্সপোর্ট সেবা প্রদানকারী, ইত্যাদি ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
- আবাসন খাত: এলাকায় ছোট রিসোর্ট ও আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
- রাজস্ব সৃষ্টি: প্রবেশ ফি ও অন্যান্য চার্জ স্থানীয় সরকারকে রাজস্ব প্রদান করছে, যা এলাকার উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেবতাখুম থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪.৫ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে।
স্থানীয় উৎপাদন ও হস্তশিল্প
দেবতাখুম পর্যটনের প্রভাবে স্থানীয় উৎপাদন ও হস্তশিল্প খাত উল্লেখযোগ্য উন্নতি লাভ করেছে:
- হস্তশিল্প: স্থানীয় বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্য, হাতে বোনা কাপড়, কাঠের মূর্তি ইত্যাদি পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয়।
- খাদ্য উৎপাদন: স্থানীয় মশলা, মধু, আচার, ইত্যাদি পর্যটকদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে।
- প্রাকৃতিক ঔষধি পণ্য: স্থানীয় ভেষজ ঔষধ ও প্রাকৃতিক পণ্য, যেমন কাঠের তেল, মেডিসিনাল হার্ব ইত্যাদি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
দেবতাখুম ভ্রমণের সেরা সময় কখন?
দেবতাখুম ভ্রমণের সর্বোত্তম সময় হল নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস। এই সময়ে আবহাওয়া শুষ্ক ও আরামদায়ক থাকে, আর জলের রঙ সবচেয়ে স্বচ্ছ ও নীল হয়। বর্ষা মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) ভ্রমণ এড়িয়ে চলাই ভাল, কারণ এই সময়ে পথ পিচ্ছিল হয় এবং জলের স্বচ্ছতা কমে যায়।
দেবতাখুমে যাওয়ার জন্য কী কী অনুমতি প্রয়োজন?
দেবতাখুমে যাওয়ার জন্য নিম্নলিখিত অনুমতিগুলি প্রয়োজন:
- বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বান্দরবান ভ্রমণের অনুমতি
- স্থানীয় সেনা ক্যাম্প থেকে নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স
- রোয়াংছড়ি উপজেলা পরিষদ থেকে ট্রেকিং পারমিট
বিদেশী পর্যটকদের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত অনুমতি প্রয়োজন হতে পারে।
দেবতাখুমে কোথায় থাকা যায়?
দেবতাখুমে থাকার জন্য কয়েকটি বিকল্প রয়েছে:
- দেবতাখুমের কাছে বন বিভাগের রেস্ট হাউস (আগে থেকে বুকিং করতে হবে)
- স্থানীয় ইকো কটেজ (সীমিত সংখ্যক উপলব্ধ)
- টেন্ট ক্যাম্পিং (নিজের টেন্ট নিয়ে যেতে হবে বা স্থানীয় গাইডের মাধ্যমে ব্যবস্থা করতে হবে)
- রোয়াংছড়ি উপজেলা সদরে কিছু রেস্ট হাউস ও আবাসিক হোটেল রয়েছে
দেবতাখুমে সাঁতার কাটা কি নিরাপদ?
দেবতাখুমের কিছু নির্দিষ্ট অংশে সাঁতার কাটা নিরাপদ, তবে জলের গভীরতা স্থান ভেদে ভিন্ন। সাঁতার কাটার আগে স্থানীয় গাইডের পরামর্শ নেওয়া এবং লাইফ জ্যাকেট পরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপরিচিত স্থানে সাঁতার কাটা থেকে বিরত থাকুন এবং বর্ষা মৌসুমে সাঁতার কাটা এড়িয়ে চলুন।
একা দেবতাখুম ভ্রমণ কি সম্ভব?
একা দেবতাখুম ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হয়। দেবতাখুমের পথ জটিল এবং কখনও কখনও বিপদজনক হতে পারে। নিরাপত্তার জন্য সর্বদা একজন স্থানীয় গাইড নিয়োগ করুন এবং গ্রুপে ভ্রমণ করুন। স্থানীয় ভাষা ও পথঘাট না জানা ব্যক্তিদের জন্য একা ভ্রমণ বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। উপরন্তু, পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়মাবলী অনুসারে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে একা ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয় না।
দেবতাখুমে ইন্টারনেট এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক কেমন?
দেবতাখুম এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক সীমিত। গ্রামিণফোন (GP) এবং রবি কিছু স্থানে সীমিত কভারেজ প্রদান করে, তবে সিগন্যাল দুর্বল এবং অনিয়মিত। ইন্টারনেট সংযোগ আরও সীমিত এবং ধীর। অতএব, আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য আগে থেকে ডাউনলোড করে রাখুন, অফলাইন মানচিত্র ব্যবহার করুন, এবং জরুরি যোগাযোগের জন্য প্রস্তুত থাকুন। ভ্রমণের আগে পরিবার বা বন্ধুদের আপনার ভ্রমণ সূচি জানিয়ে রাখা উচিত।
রোয়াংছড়ি থেকে দেবতাখুম পর্যন্ত কত সময় লাগে?
রোয়াংছড়ি থেকে দেবতাখুম পর্যন্ত ট্রেকিং সাধারণত ৩-৪ ঘন্টা সময় নেয়, তবে এটি ব্যক্তির ফিটনেস লেভেল এবং মৌসুমের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে ট্রেকিং তুলনামূলকভাবে সহজ, কিন্তু বর্ষা মৌসুমে পথ পিচ্ছিল হয়ে এই সময় ৫-৬ ঘন্টা পর্যন্ত বাড়তে পারে। ট্রেকিং পথে বিশ্রামের জন্য কয়েকটি স্পট রয়েছে, যেখানে আপনি থামতে পারেন।
দেবতাখুমের আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
দেবতাখুম ভ্রমণের সময় আশেপাশের আরও কিছু আকর্ষণীয় স্থান দেখার পরিকল্পনা করতে পারেন:
১. রিঙ্গনপাড়া ঝর্ণা
দেবতাখুম থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রিঙ্গনপাড়া ঝর্ণা একটি মনোরম জলপ্রপাত। এই ঝর্ণার পাশে একটি ছোট মারমা গ্রাম রয়েছে, যেখানে আপনি স্থানীয় সংস্কৃতি অনুভব করতে পারেন। ঝর্ণাটি বর্ষা মৌসুমে সবচেয়ে প্রবাহমান ও সুন্দর দেখায়।
২. জাদিপাই পাহাড়
দেবতাখুম অঞ্চল থেকে দেখা যাওয়া জাদিপাই পাহাড় একটি চমৎকার ট্রেকিং স্পট। পাহাড়ের চূড়া থেকে আশেপাশের পাহাড়ি এলাকার পানোরামিক দৃশ্য দেখা যায়। এখানে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা অনন্য।
৩. রোয়াংছড়ি বাজার
রোয়াংছড়ি উপজেলার প্রধান বাজার, যেখানে স্থানীয় আদিবাসীদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি অনুভব করতে পারেন। বাজারে স্থানীয় হস্তশিল্প, খাবার এবং আদিবাসী পণ্য কিনতে পারেন। বিশেষ করে বুধবার ও শনিবার বাজারে স্থানীয় হাট বসে, যা দেখার মতো।
৪. ত্রিপুরা পাড়া
রোয়াংছড়ির কাছে অবস্থিত ত্রিপুরা পাড়া একটি ঐতিহ্যবাহী ত্রিপুরা গ্রাম, যেখানে আপনি তাদের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারেন। গ্রামবাসীরা সাধারণত বিদেশীদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ও সংগীত দেখানোর জন্য আগ্রহী।
সর্বশেষ পরিবর্তন ও উন্নয়ন
দেবতাখুম অঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও উন্নয়ন হয়েছে:
পর্যটন উন্নয়ন
২০২১ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন “দেবতাখুম উন্নয়ন প্রকল্প” চালু করেছে, যার আওতায় নিম্নলিখিত উন্নয়ন কাজ চলছে:
- উন্নত ট্রেকিং পথ: রোয়াংছড়ি থেকে দেবতাখুম পর্যন্ত ট্রেকিং পথ উন্নত করা হচ্ছে, যাতে ভ্রমণ আরও সহজ ও নিরাপদ হয়।
- ইকো-ফ্রেন্ডলি কটেজ: দেবতাখুমের কাছে পরিবেশবান্ধব ১০টি কটেজ নির্মাণ করা হচ্ছে, যেগুলি স্থানীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি এবং স্থানীয় স্থাপত্য শৈলীতে ডিজাইন করা।
- বিশ্রাম স্পট: ট্রেকিং পথে অতিরিক্ত বিশ্রাম স্পট এবং ভিউ পয়েন্ট তৈরি করা হচ্ছে।
- তথ্য কেন্দ্র: রোয়াংছড়িতে একটি আধুনিক পর্যটন তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে দেবতাখুম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।
সংরক্ষণ উদ্যোগ
২০২৩ সালে “দেবতাখুম সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা” প্রণয়ন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে:
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: দেবতাখুম এলাকায় বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কার্যকর সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে।
- পরিবেশ মনিটরিং: জলের মান এবং জৈববৈচিত্র্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য একটি মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে।
- জনসচেতনতা: পর্যটকদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সাইনেজ ও তথ্য বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।
- স্থানীয় সম্পৃক্ততা: স্থানীয় সম্প্রদায়কে সংরক্ষণ কাজে সম্পৃক্ত করার জন্য “দেবতাখুম সংরক্ষণ কমিটি” গঠন করা হয়েছে।
উপসংহার
দেবতাখুম বাংলাদেশের এক অনন্য প্রাকৃতিক বিস্ময়, যা শুধু তার অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং তার ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত গুরুত্বের জন্যও বিখ্যাত। স্বচ্ছ নীল জলরাশি, চারপাশের ঘন সবুজ বনভূমি, এবং আদিবাসী সংস্কৃতির সমন্বয়ে দেবতাখুম একটি অনন্য পর্যটন গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
তবে, এই অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবর্ধমান পর্যটন যেন দেবতাখুমের নাজুক পরিবেশ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, সেদিকে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। দায়িত্বশীল পর্যটন, স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা, এবং সক্রিয় সংরক্ষণ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা দেবতাখুমের সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করতে পারি।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলা যায়, “প্রকৃতি যেখানে উদার হাতে দিয়েছে তার সবচেয়ে অমূল্য সম্পদ” – দেবতাখুম সেই অমূল্য সম্পদের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। আসুন, আমরা সকলে মিলে এই অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করি এবং এর অপরূপ সৌন্দর্যকে সম্মান করি।
দেবতাখুম ভ্রমণে যাওয়ার আগে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিন, স্থানীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলুন, এবং প্রকৃতির সাথে সম্মানপূর্ণ আচরণ করুন। একবার দেবতাখুমের সৌন্দর্য অনুভব করলে, আপনি বুঝতে পারবেন কেন এই স্থানটিকে “দেবতাদের জলাশয়” বলা হয় – কারণ এর সৌন্দর্য সত্যিই দিব্য ও অলৌকিক।
তথ্যসূত্র:
- বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড, “পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন গাইড,” ২০২৩।
- রাজ, ডি. “বান্দরবানের প্রাকৃতিক সম্পদ ও সংরক্ষণ,” পরিবেশ বিজ্ঞান জার্নাল, ২০২১।
- আহমেদ, এম. “পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সংস্কৃতি,” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, ২০২০।
- বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, “দেবতাখুম জৈববৈচিত্র্য সমীক্ষা,” ২০২২।
- চৌধুরী, এস. “বান্দরবানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য,” বাংলা একাডেমি, ২০১৮।